আমার জীবনের প্রভাবক তিনতলা দালান
আমাদের পুরোনো তিন তলা দালানের উপরের তলায় থাকতাম। আমার আজকের আমি’র জন্য ঋণী বা দায়ী দুটোই করব এই দালানকে।
ছিমছাম গোছানো দালানটি। হুমায়ূন আহমেদের মূল চরিত্র তথাকথিত মধ্যবিত্ত পরিবার নিয়ে লেখায় যেমন দালানের বর্ণনা পাওয়া যায়, ঠিক তেমন। উপরের তলার অর্ধেকটা জুড়ে ছাদ, আর বাকী অর্ধেকটাতে আমরা থাকতাম। আমরা বলতে মা, বাবা, দাদু, দাদি, দুই ফুপাতো ভাই আর আমি। আর পুরো দালানে আমাদের ৫১বর্তী পরিবার।
দাদু ছিলেন আমার সবচে বড় অভিভাবক।
সামনের রুমটিতে ডাইনিং, ওখানে পড়তে বসতাম। ওই রুমটিতেই দাদু থাকতেন। পাকিস্তান এয়ারফোর্সে ছিলেন। তখন ছয় বছর বয়স আমার, গল্প বলতেন আমি শুনতাম। কোনো গল্প ওভাবে মনে নেই। তবে মা’র ভাষ্যে আমি গল্পগুলো সুতোই বাঁধতে চাইতাম। আবার অন্যদের বলার চেষ্টা করতাম অন্য কাজিনদের নিজেদের নামের পাশাপাশি আদর করে নিজে কিছু নাম রেখেছিলেন। ওই নামেই ডাকতেন। আমাকে খুব আদর করে ডাকতেন ‘এয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটু’; তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ান সেই বিপ্লবী নেতার নাম। কেউ জানতে চায় নি কেন এই নাম। দাদু হাসতেন। অন্যদের নামে জানি না, তবে আমার নাম এমন কারণ হয়তো দাদুর মাঝে বিপ্লবী কিছু চেতনা ছিল। যা আমার মাঝে জ্বেলে দিতে চেয়েছিলেন।
দাদু আমাকে পাশে রেখে ইংরেজি রাইম রিসাইট করতেন। ইংরেজিতে কথা বলতেন। মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। তাঁর মত বলতে না পারলেও ওখানে উল্টা-পাল্টা শব্দ ঢুকিয়ে ছন্দ মিলাতাম। ইংরেজি ভাষাটাতে অল্প আধটু যদি ভাল হয়ে থাকি, দাদুর অবদান আছে ওখানে।
দাদু মারা যাওয়ার কিছুদিন পর থেকে আমি দাদুকে খুব অনুভব করতাম। সামনের রুমে বসে আমি ছড়া পড়তাম, লিখতাম। কষ্টকে বুঝাতাম ওভাবে।
আমাদের তিন তলা দালানটিকে আমার আজকের আমি’র জন্য দায়ী বা ঋণী বলেছিলাম। দাদুর কথা মনে পড়লে ছাদের এককোণে গিয়ে চুপ করে বসে থাকতাম। বৃষ্টি হলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিবিড়ভাবে তাকিয়ে থাকতাম। দাদুকে ভাবতাম। খুব রোদে স্কুল শেষে প্রতিদিন যে দাদুর হাসিমুখ দেখতাম, ‘আমার এয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটু আসছে’ শুনতাম, আর এসে আর শোনা হত না। ছাদের এক কোণে খাতা কলম নিয়ে বসতাম। গল্প, ছড়া লিখতাম। বিষয়বস্তু হাস্যকর ছিল। ভাবলে এখনো হাসি পায়। আমার কাজিনরা এসব দেখে ‘অকালপক্ব’ ডাকত। কিন্তু আমার ভাল লাগার জায়গা। চালিয়ে যেতাম।
আজ সারাদিন পার হল।
কয় তারিখ দেখতে হয় নি। দাদুর কথা খুব স্মরণ হচ্ছিল। পরে দেখলাম আজ ১৮ ফেব্রুয়ারি। দাদুর মৃতুবার্ষিকী।
মৃত্যুর আগে দাদু অনেক কষ্ট পেয়েছেন। শ্বাস কষ্টের সমস্যা ছিল। মৃত্যুর আগে সবাইকে দোয়া আর পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমার তখন ছয় বছর। মা সবারটা শেষে আমার জন্য দোয়া বা পরামর্শ আছে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলেন। বলেছিলেনও দাদু কিছু একটা। এখনো কোনো সমস্যা হলে বুঝি দাদুর দোয়া সাথে আছে। সমাধান হয়।
আমাদের আগের তিন তলাটাও নেই। দাদু মারা যাওয়ার বেশ কিছুদিন পরে ওটা ভেঙে নতুন দালান গড়া হয়। অনেক অনুভবের জায়গা দালানটি, ওই চিলেকোঠা; আমি হওয়ার উপাদান। আর দাদু প্রভাবক।