নর্মা জিন ওরফে মেরেলিন মনরো, ক্যালিফোর্ণিয়ার লস অ্যাঞ্জেলসে সরকারি হাসপাতালের একটি চ্যারিটি ওয়ার্ডে ১৯২৬ সালের পহেলা জুন জন্মগ্রহণ করেন । সর্বকালের সেরা অভিনেত্রীর তালিকায় তার অবস্থান তৃতীয়। খুব বেশি দিন অবশ্য ধরাধামে ছিলেন না এ অভিনেত্রী।
জীবনের জন্মের পর ১২টি বছর তিনি সরকারি বিভিন্ন শিশুসদনে কাটিয়েছেন। দরিদ্র মা গ্লেডিস পার্ল বেকার তাকে লালন-পালনের বোঝা নিতে না পেরে রেখে যান ঘরের দুই লজিং প্রতিবেশীর কাছে। নর্মার মা কাজের জন্য চলে যান হলিউডে। মাঝে মাঝে অবশ্য ছোট্ট নর্মাকে দেখে যেতেন। নর্মার যখন দুই বছর বয়স তখন নর্মার মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন । পারিবারিকভাবে পাওয়া এই অসুস্থতা পরবর্তীতে নর্মাকেও ভোগায়। আবার নর্মার স্থান হয় সরকারি শিশুসদনে। পিতৃ-মাতৃহীন জীবন চলতে থাকে নর্মার। বিভিন্ন সময় সরকারি শিশুসদনে আশ্রয় হতো নর্মার। আর্থিক অনটনের কারণে বিভিন্ন আত্মীয়ের কাছেও পালা করে থাকতে হতো। এরপর শুধু ঘুরে ঘুরে এ বাড়ি ও বাড়ি থাকা। বহির্বিশ্বে যা ‘ফস্টার হোম’ নামে খ্যাত। তিনি শিশুকালেই সম্ভ্রম হারান। আত্মীয়ের বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে আত্মীয়ের ছেলেদের দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হতেন। কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণ না থাকায় এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারতোনা নর্মা। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন কিশোরী নর্মা। লাঞ্ছনা সইতে চাইছিলেন না আর। বের হতে চাইছিলেন অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে। নর্মার পিতৃপরিচয়ের সন্ধান কখনোই পাওয়া যায়নি। এভাবে, বিভিন্ন অত্যাচারের মধ্য দিয়ে নর্মার বড় হয়ে উঠা। প্রাপ্তির খাতা যার একবারে শূন্য, তিনিই কিনা একদিন বিশ্বের সাড়া জাগানো অভিনেত্রী হলেন। সেই অপরূপ মানবী মেরেলিন মনরো।
নর্মা অসহ্যনীয় যৌন অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেতে চাইছিলো। নর্মা অনুধাবন করতে পারলো একমাত্র বিয়ে ছাড়া আর কোনোভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা
সম্ভব ছিলোনা। তাই মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রতিবেশী ২০ বছর বয়সী ডাগহার্টিকে বিয়ে করেন । এরপরের বছর ডাগহার্টি যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন মার্চেন্টে চাকরি নেন। সেই সঙ্গে নর্মাও কাজ পেয়ে যান প্যারাসুট পরিদর্শক হিসেবে। পরে সেই চাকরি ছেড়ে নিযুক্ত হন স্প্রে-পেইন্টারের কাজে। ভাগ্যের খেল হয়তো একেই বলে। সরকারিভাবে নারীদের কাজে উৎসাহিত করার জন্য প্ল্যান্টে কাজ করা নারীদের কাজ এবং কাজের পরিবেশ বিষয়ক ছবি তুলতে আসেন একজন ফটোগ্রাফার, তিনিই প্রথম নর্মাকে জানান নর্মা একজন মডেল হিসেবে দারুণ। অবশ্য তিনি তখন একজন মডেল হিসেবে নয়, বরং একজন কো-মডেল কর্মী হিসেবেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু সেদিনের কথাটি নর্মাকে ভাবায়। এরপর পার্টটাইম মডেল হিসেবে কাজ শুরু করেন নর্মা। জীবনে সবই চলছিল ঝর্ণার ছন্দের মতো, কিন্তু ছন্দের পতন হতে সময় লাগে না। বিয়ের চার বছরের মাথায় ডাগহার্টির সাথে নর্মার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় । কাজের প্রয়োজন একসময় নর্মাকে অভিনয়ের ব্যাপারে যথেষ্ট আকৃষ্ট করতে থাকে। ১৯৪৮ সারের জুন মাসে তিনি জনপ্রিয় কলম্বিয়া পিকচারের সঙ্গে মাসিক ১২৫ ডলারের ভিত্তিতে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। সেখানেই তিনি পরিচালকের পরামর্শে নর্মা জিনের পরিবর্তে হয়ে যান মেরেলিন মনরো। প্রদান ড্রামা কোচ হিসেবে তিনি কলম্বিয়া পিকচারে কাজ করতে থাকেন।
মনরোর সফলতা আসতে থাকে ১৯৫০–১৯৫২ থেকে। ১৯৫০ সালে তিনি টুয়েন্টি ফক্স সেঞ্চুরির সাথে মাসিক ৫০০ ডলার চুক্তিতে আবদ্ধ হন। প্রথম ১৯৫০ সালে মুক্তি পায় মেরেলিন অভিনীত ‘আসফাট জাঙ্গাল’। ছবিটিতে অসাধারণ অভিনয় করলেও স্বীকৃতি পাননি কারও কাছ থেকে, বরং ছবিতে অভিনয়ের চেয়ে আবেদনময়ী হিসেবে বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরপর একে একে মুক্তি পেতে থাকে এ অভিনেত্রীর একাধিক ছবি। ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে তিনি একাডেমিক এওয়ার্ড পান এবং সেপ্টেম্বর মাসে, কোলিয়ারের ন্যাশনাল ম্যাগাজিনে তার জীবন-কাহিনী নিয়ে একটা আর্টিকেল বের হয়। ১৯৫৩ সালে তিনি একজন সুপার-স্টার হিসেবে অভিনেত্রী মহলে জায়গা করে নেন। ১৯৫৪ সালে জো ডিমাগিয়োর নামের ভদ্রলোকের সাথে দ্বিতীয়বারের মতন বিয়ের সাঁজ সাজেন। ১৯৫৫ সালে তৎকালীন সময়ের দ্বিতীয়
নারী প্রযোজক হিসেবে খোলেন নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৬ সালে মেরেলিন
প্রযোজিত ‘বাস স্টপ’ নামের ছবিটি সমালোচকদেরও প্রশংসা কুড়ায়। ১৯৫৭ সালে, লেখক এবং প্রাবন্ধিক আর্থার মিলারকে বিয়ে করেন মেরেলিন। কিন্তু পাঁচ বছর পর, তৃতীয়বারের মতো ঘর ভেঙে যায় মেরেলিনের। তিনি বলেছিলেন,
“তিনি কখনও কিছু আশা করতেন না।“
মেরেলিন মনরোর সাংসারিক জীবনে ক্রমাগত ছন্দপতন, গর্ভপাত, খ্যাতি তার মানসিক অস্থিরতা বাড়িয়ে দিয়েছিল। বিভিন্ন ওষুধ এবং মদ্যপানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেন এ অভিনেত্রী। কাজের প্রতি উদাসীনতা, বেসামাল জীবনযাপন এবং পারিবারিক মানসিক অসুস্থতা মেরেলিনের জীবনের শেষ ভাগের একান্ত সঙ্গী ছিল। ১৯৬২ সালে, মাত্র ৩৬ বছর বয়সে জীবনের কাছে পরাজিত হন ইতিহাসের লাস্যময়ী এই অভিনেত্রী একাকি নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। স্বল্প আয়ু নিয়েই তিনি সারা বিশ্বের নামকরা ব্যক্তিদের ঘুম হারাম করেছেন তিনি। অভিনেত্রী, গায়িকা, মডেল ও সর্বপোরি সেরা আবেদনময়ী নায়িকা হিসেবে বিশ্বব্যাপী তার পরিচিতি মাত্র ১৬ বছরের ক্যারিয়ার হলেও মেরেলিনকে আজও সর্বকালের সেরা আবেদনময়ী অভিনেত্রী হিসেবে গণ্য করা হয়। মেরেলিন জীবদ্দশায় তার কাজের স্বীকৃতি সঠিকভাবে না পেলেও আজও তার হাসি কোটি দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করে। হয়তো এজন্যই তিনি বলে গেছেন, হাসো। কারণ জীবন অনেক সুন্দর এবং হাস্যোজ্জ্বল থাকার জন্য জীবনে অনেক কিছু আছে। যৌন আবেদন ছাড়াও তার সম্পর্কে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিলো, তার প্রেমে মশগুল ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি স্বয়ং আব্রাহাম লিংকন। তাদের প্রেম কাহিনিও ব্যাপকভাবে প্রচারিতও হয়েছিল। এভাবেই, ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকে সেরা আবেদনময়ী অভিনেত্রী মেরেলিন মনরো !
(সমাপ্ত)