আমাদের এই ব্যস্ত জীবন, কর্পোরেট কাজের চাপ আর প্রযুক্তিগত জটিলতায় নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় কই? প্রায়ই এরকম কথা শোনা যায়। কিন্তু নিজেকে নিয়ে আসলে ভাবতে হবে। নিজেকে ভালো রাখতে হবে। আজকে আলোচনা করবো কেন নিজেকে ভালো রাখবেন আর নিজে ভালো থাকার উপায় কয়েকটি সম্পর্কেও জানবো।
কেন নিজেকে নিয়ে ভাববো?
প্রথমত, নিজেকে নিয়ে ভাবা বা নিজেকে ভালো রাখা কোনো খারাপ কিছু নয়। বরং সবারই নিজের প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত। এমনকি সুস্থ জীবনযাপনের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া এবং পরিমিত খাওয়া আর সেইসাথে শরীরচর্চা করা জরুরী। জিমে যাবার সময় না পেলে যোগাসন কিংবা মর্নিং ওয়াকের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন। এতে মন- মেজাজ ভালো থাকে। যদিও একদিনে এই অভ্যাস গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তবে ধীরে ধীরে তা নিয়মিত রুটিনের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
নিজেকে এবং অন্যকে ক্ষমা করতে শিখুন।মনস্তাত্ত্বিকভাবে, এতে আপনি দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন আর যা হয়ে গেছে বা ঘটে গেছে তাকে যেতে দেবেন। উনি বলেছেন, ক্ষমা করতে না পারলে আসলে আপনি মানসিক অস্থিরতা থেকে বের হতে পারবেন না আর সেই অস্থিরতাই আপনাকে সামনে এগোতে দেবে না। বাস্তব অর্থেই পূর্বে যা ঘটে গেছে তাকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকলে ভবিষ্যতের দিকে আপনি এগোতে পারবেন না। না চাইলেও একটা পিছুটান থাকবেই। তাই অতীতকে ভুলে সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত।
প্রতিদিন নতুন কিছু করুন বা শিখুন। প্রতিদিন সেই একই দশটা- পাঁচটা অফিস, একই সময়ে পড়তে বসা, ক্লাসে যাওয়া এসব কি ভালো লাগে? তাই নিত্যদিনের আবশ্যিক কাজের বাইরেও নিজের জন্য সময় রাখুন। জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনুন। যেমন- বই পড়া, শখের কাজে সময় দেয়া, শরীরচর্চা নিয়মিত করা, প্রতিদিন কিছু সময় ছাদে বা খোলা আকাশের নিচে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করা ইত্যাদি।
নিজে ভালো থাকার উপায় আরেকটি হলো অপ্রয়োজনীয় বিশ্বাস বদলানো। যেমন- আপনি যদি মনে করেন, আমার দ্বারা সকালে উঠা হবে না কারণ আমি রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পারি না। এই বিশ্বাস নিয়ে চললে আপনি নিজের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারবেন না। আপনাকে ভাবতে হবে- আমি তাড়াতাড়ি উঠবো আবার রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েও পড়বো। বেশি রাত জাগবো না। তাহলেই আপনি পারবেন। এরপর কিছুদিনের মধ্যে দেখবেন এলার্ম ছাড়াই নিজের থেকে ঘুম ভেঙ্গে যাবে। এই চিন্তাধারার পদ্ধতিকে বলে ওয়ান স্টেপ ফরওয়ার্ড থিঙ্কিং। অর্থাৎ আপনি পারবো না বা আমার দ্বারা সম্ভব নয় এই ধারণা থেকে একধাপ এগিয়ে আমি পারবো বা আমি করবো এই পর্যায়ে উঠে এসেছেন। এভাবেই আপনি আপনার অপ্রয়োজনীয় বিশ্বাস বদলে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবেন আর নিজেকে ভালো রাখতে পারবেন।
আরেকটি উদাহরণ দেই। ধরুন আপনি ধরেই নিয়েছেন আমি খারাপ স্টুডেন্ট। আমি কিছু পারি না। আমার দ্বারা কিছু হবে না। তাহলে আপনি হেরে যাবেন। কিন্তু যদি আপনি ভাবেন, আমি পড়বো। আমার ঘাটতিগুলো খুঁজে বের করবো। চর্চার অভ্যাস করবো। নিয়মিত পড়াশোনা করবো। তাহলেই আপনি পারবেন। মনে রাখবেন, মানুষের পক্ষে অসম্ভব কিছু নেই।
এছাড়া সুস্থ থাকতে হলে আপনার খাদ্যতালিকায় ফলমূল, শাকসবজি রাখুন। চর্বি বা চিনি জাতীয় খাবার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন। নিজেকে ভালো রাখতে হলে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়াদির সাথে শরীরের দিকে নজর দিতে হবে। নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস করুন। বাসা থেকে একটু আগে বেরিয়ে কাছাকাছি বাসস্ট্যান্ড বা অন্য জায়গা যেমন- বাজার, শপিং মল বা সুপারশপে হেঁটে যাওয়া- আসার অভ্যাস করতে পারেন। পরিমিত খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন। পর্যাপ্ত ঘুম শরীরের জন্য ভীষণ দরকার। চেষ্টা করবেন ঘুমের সময়টা ঠিক রাখতে।
তবে বর্তমানে জীবনযাপনের ধরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ইন্টারনেট আর প্রযুক্তির কারণে তথ্য সহজলভ্য হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে আমরা বর্তমানে ৯০% সময় চিন্তা করেই কাটিয়ে দেইআর মাত্র ১০% সময় কাজে ব্যয় করি। এতে কাজের গুণগত মান কমছে। তাছাড়া আমরা এতই ব্যস্ত আর অধৈর্য্য হয়ে পড়ছি যে একটা কাজে প্রদত্ত গড় সময় আর মনোযোগ দুটোই কমে আসছে। তাই প্রযুক্তির পেছনে সময় অপচয় না করে আমাদের স্কিল ডেভোলাপমেন্টের দিকে নজর দেয়া উচিত।
আরও কিছু বিষয় আছে যা আপনাকে ভালো থাকতে সাহায্য করবে। যেমন: অন্যের প্রতি প্রত্যাশা কমিয়ে দিন। আস্থা রাখুন নিজের প্রতি। কর্মক্ষেত্রে, ক্যারিয়ার, আর্থিক সব দিক থেকেই সাধারণ উপায়ের বিপরীতে বিকল্প রাস্তা চিন্তা করে রাখুন। অযথা তর্কে জড়াবেন না। চেষ্টা করবেন ব্যক্তিগত তথ্য এবং ভাবনা সবসময় সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার না করতে। জেনে রাখবেন, সবাইকে সব কথা বলা যায় না। তাহলে আপনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন।
নিজেকে ভালো রাখতে চাইলে কখনোই সবকিছুতে হ্যাঁ বলবেন না। অপছন্দের কিছুকে না বলতে শিখুন। কিছুতেই নিজেকে সহজলভ্য হিসেবে জাহির করবেন না যাকে যে কোনো প্রয়োজনে পাওয়া যায়। তাহলে অপরের প্রত্যাশা আপনার প্রতি বেড়ে যাবে আর সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলে অন্যরা আপনার উপর ক্ষিপ্ত হবে আর আপনি হতাশার মধ্যে পড়ে যাবেন। নিজের প্রতি বিশ্বাস হারাবেন না। কোনো সঙ্গী না পেলে নিজের সাথেই কথা বলুন। ডায়েরি লেখার অভ্যাস করতে পারেন। এতে চাপমুক্ত থাকা যায়। আর নেতিবাচক চিন্তাগুলোকে ফিল্টার করুন আর ভাবুন যে সেখান থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়। যারা আপনাকে ছোট করবে বা নিচু মানসিকতার পরিচয় দেয় তাদের থেকে দূরে থাকুন। বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করুন। তাদের সাথে কথা বলে আপনার সময়ও ভালো কাটবে আর জ্ঞানও বাড়বে।
মাঝে মাঝে উপায় বদল করে কাজ করার অভ্যাস করুন। কখনো হার মানবেন না। গৎবাঁধা বিষয়ের বাইরে চিন্তা করুন। রোবটের মতো প্রতিদিন একই রুটিন না মেনে জীবনযাপনে কিছু বদল আনতে পারেন। যেমন- ছুটির দিনটা নিজের মতো করে উপভোগ করুন। পরিবারকে সময় দিন। এমনকি কাছাকাছি কোথাও বেড়িয়েও আসতে পারেন। কারণ সবসময় কাজের মধ্যে থাকলে আপনি মানসিক অস্থিরতায় ভুগবেন।
এছাড়া কাজের চাপে শখের কাজ যেমন- ছবি আঁকা, লেখালেখি করা, গান করা ইত্যাদি ছেড়ে দেবেন না। সবসময় সোশ্যাল মিডিয়ায় না থেকে প্রকৃতি উপভোগ করুন। বাইরে যান। খোলা জায়গায় হাঁটুন কিংবা সময় কাটান। আর অন্য আপনাকে নিয়ে কি ভাবছে সেটা নিয়ে এত মাথা ঘামাবেন না। নিজের উপর আস্থা রাখুন। যদি প্রতিযোগিতা করতেই হয় নিজের সাথে করুন। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিত্যদিনের কাজের তালিকা(ডেইলি রুটিন) তৈরি করে এবং সে অনুযায়ী চলে বা চলার চেষ্টা করে তাদের সফলতার হার সবচেয়ে বেশি। কারণ এতে কাজের হিসাব থাকে। আর অতিরিক্ত চাপ মাথায় কাজ করে না। কেননা কি কি কাজ করা হয়ে গেছে আর কি কি বাকি আছে তার হিসেব থাকে। আর অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করবেন না। কাজ যেমন করবেন, তেমন মাঝে বিরতি নেয়ার কথাটাও মাথায় রাখবেন।
এখন মনে করুন, আপনার চাকরি বা অফিসে আপনার উপর কাজের অনেক চাপ। অথচ আপনি সেই কাজে আগ্রহী নন। মাস শেষে বেতন আসছে ঠিকই কিন্তু আপনি খুশি নন। অথচ জীবনযাপনের খরচ তো বহন করতে হবে। তাই মুখ বুঁজে দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু নিজেকে ভালো রাখতে হলে আত্মতুষ্টির দিকে নজর দিন। সাময়িক সুখ বা সুবিধার কথা চিন্তা না করে দীর্ঘমেয়াদি সন্তুষ্টির কথা ভাবুন।
এবার মূল আইডিয়াগুলোর সারমর্ম করে নেয়া যাক। প্রথমত নিজেকে ভালো রাখা বা ভালো রাখতে চাওয়াটা কোনো অপরাধ নয়। দ্বিতীয়ত নিজেকে নিয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে। এটা মোটেও স্বার্থপরতা নয়। তৃতীয়ত দায়িত্ব বা কাজের চাপে নিজেকে অবহেলা করা উচিত নয়। নিজেকে ভালো রাখতে হলে-
নিজে ভালো থাকার উপায়
১| নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হতে হবে। কারণ স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল।
২| নিজেকে এবং অপরকে ক্ষমা করতে শিখুন।
৩| অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকার অভ্যাস বাদ দিন। ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যান।
৪| প্রতিদিন নতুন কিছু শিখুন।
৫| নিজের চিন্তাধারার পরিবর্তন আনতে হে।
৬| Over thinking এর অভ্যাস পরিবর্তন করুন।
৭| অন্যের প্রতি প্রত্যাশা কমিয়ে আনুন।
৮| সবসময় বিকল্প উপায় ভেবে রাখবেন।
৯| না বলতে শিখুন।
১০| প্রতিদিনের রুটিন তৈরি করুন আর সেই অনুযায়ী কাজ ভাগ করে নিন।
১১| Short term joys এর বদলে Long term satisfaction এর প্রতি মনোযোগী হোন।
এই ছিলো আজকের মতো। আশা করছি নিজের উপর যত্নবান হতে গেলে উপরে বর্ণিত উপায়গুলো আপনার কাজে লাগবে। নিজেকে এতখানি অবহেলা করবেন না যাতে পরে আফসোস করা লাগে। অবশ্যই নিজের কথা ভাববেন এবং নিজেকে নিয়েই ভাববেন কারণ আপনাকে আপনার থেকে ভালো আর কেউ জানে না।
আজ এই পর্যন্তই। পোস্টটি কেমন লাগলো দয়া করে কমেন্টে জানাবেন, যদি ভাল লেগে থাকে তাহলে অবশ্যয় শেয়ার করবেন, পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। এমন সব দারুন দারুন পোস্ট পেতে Grathor এর সাথেই থাকুন এবং গ্রাথোর ফেসবুক পেইজ ও ফেসবুক গ্রুপ এ যুক্ত থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।